কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো নিয়ে টানাপোড়ন!

ডেস্ক রিপোর্ট •

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া ৩৪টি শরনার্থী শিবির থেকে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো নিয়ে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে চলছে টানাপোড়ন।

সরকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে সরকার এখনও তাদের স্থানান্তর করার তারিখ ঠিক করতে পারেনি। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে।

তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার আগে জায়গাটি যে বসবাসের জন্য নিরাপদ সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মো: এনামুর রহমান বলেছেন, এবিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের ভাসানচর পরিদর্শন করানোর পরিকল্পনাও সরকার নিয়েছে।

দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছার কারণে ক্যাম্প থেকে এখনও পর্যন্ত সেখানে একজনকেও পাঠানো সম্ভব হয়নি।

ডিসেম্বরেই আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছিল- পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এমন বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সাথে জড়িত কর্মকর্তারাও বলেছেন, স্থানান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার ব্যাপারে সরকারের তাগিদও রয়েছে।

তারা উল্লেখ করেছেন, এখন রোহিঙ্গাদের অনেকে ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা আগ্রহী প্রায় তিন হাজার জনের তালিকাও করেছেন। কিন্তু স্থানান্তর শুরু করার তারিখ তারা ঠিক করতে পারছেন না। সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির কথা তুলে ধরা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ডা: মো: এনামুর রহমান বলেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদেরও ভাসানচর পরিদর্শনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে।

“পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং ইউএনসিআর সহ সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় যাবে, শুধু তাদেরকেই নেয়া হবে। এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঐ প্রকল্প পরিদর্শন করবেন। সেরকম একটা আয়োজনও আমরা করছি।”

কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থানান্তর শুরু করার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এখনও কাটছে না।

সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেই বিভিন্ন সময় অভিযোগ করা হয় যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে আপত্তি করছে। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় ৩৪টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে।

তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, তারা বিষয়টাতে আপত্তি করেনি। তাদের পক্ষ থেকে গত বছর ভাসানচরে মিশন পাঠিয়ে সুরক্ষা এবং কারিগরী মূল্যায়ন করার জন্য সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন জবাব এখনও মেলেনি।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার বা ইউএনএইচসিআর এর একজন মুখপাত্র লুইস ডনোভান বলছিলেন, “জাতিসংঘ, সরকারকে এরই মধ্যে জানিয়েছে যে তারা ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করার জন্য একটি সুরক্ষা মিশন (প্রটেকশন মিশন) পাঠাতে আগ্রহী। আমরা এরই মধ্যে আমাদের শর্তাবলী (টার্মস অফ রেফারেন্স)তাদেরকে জানিয়েছি এবং তাদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি।

কোন স্থানান্তর শুরু হবার আগেই জাতিসংঘ ঐ দ্বীপে আরো বৃহত্‍ একটি সুরক্ষা এবং কারিগরী পর্যালোচনা করতে আগ্রহী। তবে এই মিশনটি হবে সেটি থেকে আলাদা। এবং সরকারও যা বলেছে, অবশ্যই যেকোন স্থানান্তরই হতে হবে স্বেচ্ছায়। আমরা আশা করছি ঐ দ্বীপে আমরা এই সুরক্ষা এবং কারিগরী মূল্যায়নটি করতে পারবো,” বলেছেন লুইস ডনোভান।

যদিও সরকার এখন বলছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের ভাসানচর পরিদর্শনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে কারিগরী মূল্যায়ন করতে চাইছে, সে ব্যাপারে সরকার এখনও কিছু বলছে না।

কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের একজন নেতা মো: আমিন বলেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাসানচরে যেতে রাজি আছে। আবার অনেকে যেতে চায় না বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

ভাসানচরে অবকাঠামো নির্মাণের পর গত মে মাসে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হয়েছে। তারা অবশ্য নৌকায় করে মালেয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে ধরা পড়েছিল। কিছুদিন আগে তারা সেখান থেকে তাদের ফেরত পাঠানোর দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল। তখন তাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করেন শিউলী। তিনি বলেছেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্যের নিরাপত্তাসহ সার্বিকভাবে সুরক্ষা নিশ্চিত না করে স্থানান্তর করা ঠিক হবে না।

কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের তারিখ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে ঠিক করবে। তবে তারা মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রসঙ্গত,মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও এর আগে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ক্যাম্প নির্মাণ করে তাদের আশ্রয় দিলেও তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি বরাবরই দাবি জানিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরপরও আশ্রয় দেওয়ায় তাদের মানবিক নানা সুযোগ সুবিধার ব্যাপারও সরকারকে ভাবাচ্ছে। তাই এ পরিস্থিতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি ক্যাম্পগুলো থেকে সরিয়ে আরও নিরাপদে রাখতে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভাসানচরের আশ্রয় ক্যাম্পে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে।

রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকায় বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে।

রোহিঙ্গাদের নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ দরকার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।

মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ফন লিনদে, স্পেনের রাষ্ট্রদূত ফ্রান্সিসকো দি ওসিস বেনেতিজ সালাস ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূত অ্যাসপেন রিকতার সেভেন্দসেনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি একথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর চাপ তৈরি করা দরকার।’

ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা যাত্রার তিন বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অনুকূল পরিবেশ তৈরি না করায় একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।

এ সময় তিন রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত হওয়ার পর নিজভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ মানবিকতার প্রশংসা করেন।

বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারস্পরিক স্বার্থের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।

ড. মোমেন এ তিনটি দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে পারস্পরিক স্বার্থে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে গত এক দশকে বাংলাদেশের নানান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুইডিশ, স্পেনীয় এবং নরওয়েজিয়ান বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে হাইটেক পার্কে আইসিটি খাতে বিনিয়োগের জন্যও আবদুল মোমেন তাদের অনুরোধ করেন।